
খোকন আহম্মেদ হীরা >
পুরনোরূপে ফিরিয়ে আনতে বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার লাকুটিয়ার ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে সংস্কার কাজ শুরু করা হয়েছে।
ফলে ধ্বংসপ্রায় প্রাসাদতম জমিদার ভবন সংরক্ষণের মাধ্যমে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্থাপত্যরীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নতুন করে প্রাণ ফিরে পেতে যাচ্ছে।

বরিশাল বিভাগীয় জাদুঘরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাবুগঞ্জ উপজেলার লাকুটিয়ায় অবস্থিত জমিদার বাড়ির সংস্কার কাজ গত ৪ মে শুরু হয়েছে। দ্বিতল জমিদার ভবনের চারিপাশে নির্মাণ করা হচ্ছে গোলাকার ইটের পিলার। ভেঙে ফেলা হয়েছে পুরোনো ছাদ। সাতক্ষীরা থেকে আনা টালি দিয়ে নতুন ছাদ নির্মাণ করা হবে।
বরিশাল বিভাগীয় জাদুঘরের সহকারী কাস্টেডিয়ান আরিফুর রহমান বলেন, প্রথমপর্যায়ে ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে মূলত ভবনের ভিত্তি, ইটের গাঁথুনি ও ছাদ নির্মাণের কাজ হচ্ছে।
তবে প্রাচীণ দরজা-জানালা, মেঝে এবং আলো-বাতাস চলাচলের কাঠামো আপাতত এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত নয়। এগুলো পরবর্তী ধাপে যুক্ত করা হতে পারে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন বলেন, পুরোনো ছবি ও ঐতিহাসিক বর্ণনার ভিত্তিতে আমরা চেষ্টা করছি ভবনটিকে তার প্রকৃত রূপে ফিরিয়ে আনতে।

জাদুঘর কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, জমিদার বাড়ির উচ্চতা ৮ দশমিক ২০ মিটার, দৈর্ঘ্য ২৫ দশমিক ৪০ মিটার ও প্রস্থ ৯ দশমিক ২০ মিটার।
দ্বিতল ভবনটিতে মোট নয়টি কক্ষ রয়েছে। তবে বাড়ির এক পাশে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) গোডাউন ও ট্রাক্টর রাখার ঘর থাকায়
ভবনটির নান্দনিকতা ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করেন পরিবেশবাদীরা। পেছনের পাকা উঠানে বীজ শুকানো হয়, যা এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার পরিবেশের সাথে সাংঘর্ষিক।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিঙ্কন বায়েন বলেন, বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তবে জমিদার বাড়ির পাশেই বিএডিসির গুদাম ও স্থাপনা থাকায় এর সৌন্দর্য এবং প্রত্নতাত্ত্বিক আবেদন মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে। এগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া জরুরি, তা না হলে ঐতিহাসিক গুরুত্ব কমে যেতে পারে।

জেলা প্রশাসনের অর্পিত সম্পত্তি বিষয়ক কৌশলি সুভাষ চন্দ্র দাস বলেন, সরকার ইতোমধ্যে জমিদার বাড়ির সীমানাভুক্ত প্রায় আট একর জমি এবং একটি বড় পুকুরের মালিকানা পেয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে পারলে এটি একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।
ঐতিহাসিক পট ভূমি :
ঐতিহাসিক তথ্য উপাত্ত থেকে জানা গেছে, জমিদার রূপচন্দ্র রায় ছিলেন লাকুটিয়া জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর নাতি রাজচন্দ্র রায়ের সময় জমিদারির পরিধি ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। তিনি প্রায় ৪৯ দশমিক ৫০ একর জমির ওপর মূল জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেন।
প্রজাদরদি হিসেবে খ্যাত রূপচন্দ্র রায়ের আমলেই লাকুটিয়া থেকে বরিশাল পর্যন্ত সড়ক নির্মিত হয়েছে। রূপচন্দ্রের দুই ছেলে রাখাল চন্দ্র রায় ও প্যারীলাল রায় ছিলেন ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী। প্যারীলাল রায় ছিলেন একজন বিশিষ্ট ব্যারিস্টার ও সমাজসেবক। তাঁর দুই ছেলে বিখ্যাত বৈমানিক ইন্দ্রলাল রায় এবং নামকরা বক্সার পরেশলাল রায় তাঁদের কীর্তির জন্য ইতিহাসে স্মরণীয়।
এই জমিদার পরিবারের সাথে ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয়তার সম্পর্ক। কবিগুরুর বড় ভাই বিখ্যাত চিত্রশিল্পী দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই ছেলে অরুণেন্দ্রনাথ ও দীপেন্দ্রনাথ বিয়ে করেন রাজচন্দ্র রায়ের দুই নাতনী সুশীলা ও চারুবালাকে।

জনহিতৈষী এই জমিদারবংশের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় বরিশালের রাজচন্দ্র কলেজ ও পুস্পরানী চৌধুরী ইনস্টিটিউশন (পিআরসি স্কুল)। যদিও কলেজটি এখন আর নেই, স্কুলটি এখনো সক্রিয়।
পরবর্তী সময়ে জমিদার দেবেন লাল রায় চৌধুরী ভারতে চলে যান এবং কলকাতায় থাকাবস্থায় পরলোকগমন করেন। তাঁর মেয়ে মন্দিরা রায় চৌধুরীর বিয়ে হয় বরিশালের কাশিপুরের মুখার্জি পরিবারে।
২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোহাম্মদ সফিউর রহমানকে এক চিঠিতে জমিদার বাড়ির পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানান, অস্ট্রেলিয়ার উচ্চ আদালতের সলিসিটার ও জমিদার পরিবারের উত্তরাধিকারী পঙ্কজ রায়ের কন্যা আলপনা রায়।
চিঠিতে তিনি ভবনটিকে একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণের জোর দাবি করেন। তাঁর এই চিঠির ভিত্তিতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বরিশাল জাদুঘরকে প্রস্তাব তৈরির নির্দেশ দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় শুরু হয় পুনরুদ্ধার কার্যক্রম।
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী আলপনা রায় বলেন, আমার বাবা পঙ্কজ রায় চৌধুরীর মুখে শুনেছি জমিদার বাড়ির ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয়তার পাশাপাশি এখনকার খ্যাতিমান লেখিকা অরুন্ধতী রায় এই পরিবারের সাথে উত্তরাধিকারসূত্রে যুক্ত।
বাড়িটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে আমি কয়েক বছর আগে সরকারের কাছে সংরক্ষণের আহবান জানিয়েছিলাম। আজ তা বাস্তবায়িত হতে দেখে আমি সত্যি আনন্দিত।
জমিদার বাড়িটির চারপাশে রয়েছে তিনটি সান বাঁধানো পুকুর, যেগুলো বাবুর পুকুর নামে পরিচিত। বহু বছর ধরে দর্শনার্থীরা ভবনটি দেখতে আসলেও সংরক্ষণের অভাবে হতাশ হয়ে ফিরতেন।
সংস্কারকাজ শুরু হওয়ায় দর্শনাথীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। তাঁদের প্রত্যাশা ভবিষ্যতে ভবনটির পূর্ণাঙ্গ সংরক্ষণ ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে, যাতে ইতিহাস জীবন্ত হয়ে ওঠে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহমান থাকে।
More Stories
গৌরনদীতে সর্টপিচ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট
ইমামকে রাজকীয় বিদায় সংবর্ধনা
পার্কিং করে রাখা ট্রাকের সাথে চারটি পরিবহনের সংঘর্ষ : ৩০ যাত্রী আহত